Breaking News

আনোয়ার কাজী নজরুল ইসলাম

 আনোয়ার 

কাজী নজরুল ইসলাম








[চারিদিকে নিস্তব্ধ নির্বাক। সেই মৌনা নিশীথিনীকে ব্যথা দিতেছিল শুধু কাফ্রি-সাস্ত্রীর পায়চারির বিশ্রী খট্‌খট্ শব্দ। ঐ জিন্দানখানায় মহাবাহু আনোয়ারের জাতীয়-সৈন্যদলের সহকারী এক তরুণ সেনানী বন্দী। তাহার কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, ডাগর চোখ, সুন্দর গঠন– সমস্ত-কিছুতে যেন একটা ব্যথিত-বিদ্রোহের তিক্ত-ক্রন্দন ছলছল করিতেছিল। তরুণ প্রদীপ্ত মুখমণ্ডলে চিন্তার রেখাপাতে তাহাকে তাহার বয়স অপেক্ষা অনেকটা বেশি বয়স্ক বোধ হইতেছিল।

সেইদিনই ধামা-ধরা সরকারের কোর্ট-মার্শালের বিচারে নির্দ্ধারিত হইয়া গিয়াছে যে, পরদিন নিশিভোরে তরুণ সেনানীকে তোপের মুখে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।

আজ হতভাগ্যের সেই মুক্তি-নিশীথ, জীবনের সেই শেষরাত্রি। তাহার হাতে, পায়ে, কটিদেশে, গর্দানে উৎপীড়নের লৌহ-শৃঙ্খল। শৃঙ্খল-ভারাতুর তরুণ সেনানী স্বপ্নে তাহার ‘মা’-কে দেখিতেছিল। সহসা চীৎকার করিয়া সে জাগিয়া উঠল। তাহার পর চারিদিকে কাতর নয়নে একবার চাহিয়া দেখিল, কোথাও কেহ নাই। শুধু হিমানি-সিক্ত বায়ু হা হা স্বরে কাঁদিয়া গেল, ‘হায় মাতৃহারা!’

স্বদেশবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা স্মরণ করিয়া তরুণ সেনানী ব্যর্থ-রোষে নিজের বাম বাহু নিজে দংশন করিয়া ক্ষত-বিক্ষত করিতে লাগিল। কারাগৃহের লৌহ-শলাকায় তাহার শৃঙ্খলিত দেহভার বারেবারে নিপতিত হইয়া কারা-গৃহ কাঁপাইয়া তুলিতেছিল।

এখন তাহার অস্ত্র-গুরু আনোয়ারকে মনে পড়িল। তরুণ বন্দী চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘আনোয়ার!’–]


আনোয়ার! আনোয়ার!

দিলাওয়ার তুমি, জোর তলওয়ার হানো, আর

নেস্ত-ও-নাবুদ করো, মারো যত জানোয়ার!

আনোয়ার! আফসোস্!

বখতেরই সাফ্ দোষ,

রক্তেরও নাই ভাই আর সে যে তাপ জোশ,

ভেঙে গেছে শম্‌শের–পড়ে আছে খাপ কোষ!

আনোয়ার! আফসোস্!


আনোয়ার! আনোয়ার!

সব যদি সুম্‌সাম, তুমি কেন কাঁদো আর?

দুনিয়াতে মুসলিম আজ পোষা জানোয়ার!

আনোয়ার! আর না!–

দিল্ কাঁপে কার না?

তল্‌ওয়ারে তেজ নাই! –তুচ্ছ স্মার্ণা,

ঐ কাঁপে থরথর মদিনার দ্বার না?

আনোয়ার! আর না!


আনোয়ার! আনোয়ার!

বুক ফেড়ে আমাদের কলিজাটা টানো, আর

খুন করো –খুন করো ভীরু যত জানোয়ার!

আলোয়ার! জিঞ্জির–

পরা মোরা খিঞ্জির!

শৃঙ্খলে বাজে শোনো রোণা রিণ-ঝিণ্ কির,–

নিবু নিবু ফোয়ারা বহ্নির ফিন্‌কির!

গর্দানে জিঞ্জির!


আনোয়ার! আনোয়ার!

দুর্বল্ এ গিদ্‌ধড়ে কেন তড়্‌পানো আর?

জোরওয়ার শের কই? জের্‌বার জানোয়ার!

আনোয়ার! মুশ্‌কিল

জাগা কঞ্জুশ্-দিল,

ঘিরে আসে দাবানল তবু নাই হুঁশ তিল!

ভাই আজ শয়তান ভাই-এ মারে ঘুষ কিল!

আনোয়ার! মুশ্‌কিল!


আনোয়ার! আনোয়ার!

বেইমান মোরা, নাই জান আধ-খানও আর।

কোথা খোঁজো মুস্‌লিম? –শুধু বুনো জানোয়ার!

আনোয়ার! সব শেষ!–

দেহে খুন অবশেষ!–

ঝুটা তেরি তলওয়ার ছিন্ লিয়া যব্ দেশ !

আওরত সম ছি ছি ক্রদন রব পেশ ! !

আনোয়ার ! সব শেষ !


আনোয়ার ! আনোয়ার !

জনহীন এ বিয়াবানে মিছে পস্তানো আর !

আজো যারা বেঁচে আছে তারা খ্যাপা জানোয়ার !

আনোয়ার ! –কেউ নাই !

হাথিয়ার? –সেও নাই !

দরিয়াও থম্‌থম্ নাই তাতে ঢেউ, ছাই !

জিঞ্জির গলে আজ বেদুঈন-দে'ও ভাই !

আনোয়ার ! কেউ নাই !


আনোয়ার ! আনোয়ার !

যে বলে সে মুস্‌লিম– জিভ্ ধরে টানো তার !

বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার !

আনোয়ার ! ধিক্কার !

কাঁধে ঝুলি ভিক্ষার–

তল্ওয়ারে শুরু যার স্বধীনতা শিক্ষার!

যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিক্‌দার!

আনোয়ার! ধিক্কার!


আনোয়ার ! আনোয়ার!

দুনিয়াটা খুনিয়ার, তবে কেন মনো আর

রুধিরের লোহু আঁখি? –শয়তানি জানো সার!

আনোয়ার ! পঞ্জায়

বৃথা লোকে সম্‌ঝায়,


ব্যথা-হত বিদ্রোহী দিল্‌ নাচে ঝন্‌ঝায়,

খুন-খেগো তল্‌ওয়ার আজ শুধু রণ্ চায়,

আনোয়ার ! পঞ্জায়!

আনোয়ার ! আনোয়ার!

পাশা তুমি নাশা হও মুসলিম-জানোয়ার,

ঘরে যত দুশ্‌মন, পরে কেন হানো মার?–

আনোয়ার ! এসো ভাই!

আজ সব শেষও যাই!–

ইস্‌লামও ডুবে গেল, মুক্ত স্বদেশও নাই!-

তেগ ত্যাজি বরিয়াছি ভিখারির বেশও তাই!

আনোয়ার ! এসো ভাই!!




[সহসা কাফ্রি সাস্ত্রীর ভীম চ্যালেঞ্জ্ প্রলয়-ডম্বরু-ধ্বনির মতো হুঙ্কার দিয়া উঠিল– 'এয়্ নৌজওয়ান, হুঁশিয়ার!' অধীর ক্ষোভে তিক্ত রোষে তরুণের দেহের রক্ত টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল! তাহার কটিদেশের, গর্দানের, পায়ের শৃঙ্খল খানখান হইয়া টুটিয়া গেল, শুধু হাতের শৃঙ্খল টুটিল না। সে সিংহ-শাবকের মতো গর্জন করিয়া উঠিল–]

এয়্ খোদা! এয়্ আলি! লাও মেরি তলোয়ার!


[সহসা তাহার ক্লান্ত আঁখির চাওয়ায় তুরস্কের বন্দিনী মাতৃ-মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। ঐ মাতৃমূর্তির পার্শ্বেই তাহার মায়েরও শৃঙ্খলিত ভিখারিনি বেশ। তাঁদের দুইজনেরই চোখের কোণে দুই বিন্দু করিয়া করুণ অশ্রু। অভিমানী পুত্র অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইয়া কাঁদিয়া উঠিল–]


ও কে? ও কে ছল আর?

না-মা, মরা জানকে এ মিছে তর্‌সানো আর!

আনোয়ার ! আনোয়ার!!


[কাপুরুষ প্রহরীর ভীম প্রহরণ বিনিদ্র বন্দী তরুণ সেনানীর পৃষ্ঠের উপর পড়িল। অন্ধ কারাগারের বন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাহারই আর্ত প্রতিধ্বনি গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল-'আঃ-আঃ-আঃ!'

আজ নিখিল বন্দী-গৃহে গৃহে ঐ মাতৃমুক্তিকামী তরুণেরই অতৃপ্ত কাঁদন ফরিয়াদ করিয়া ফিরিতেছে। যেদিন এ ক্রন্দন থামিবে, সেদিন সে-কোন্ অচিন্ দেশে থাকিয়া গভীর তৃপ্তির হাসি হাসিব জানি না! তখন হয়তো হারা-মা-আমার আমায় 'তারার পানে চেয়ে চেয়ে' ডাকবেন। আমিও হয়তো আবার আসিব। মা কি আমায় তখন নূতন নামে ডাকিবেন? আমার প্রিয়জন কি আমায় নূতন বাহুর ডোরে বাঁধিবে? আমার চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে, আর কেন যেন মনে হইতেছে, 'আসিবে সেদিন আসিবে!

No comments