Breaking News

উমর ফারুক কাজী নজরুল ইসলাম।




তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে।

প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!


আমির-উল-মুমেনিন,

তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।

তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,

বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?

ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?

মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?


আবার লুটায়ে পড়ি।

'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।

উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!

আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!

ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!

সত্যের আলো নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।

শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের

দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের

ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি

আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!


ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?

পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।

আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-

'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'


অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি

খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি

সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে,

ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে।

শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ

করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।

সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,

বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।


হেরি পশ্চাতে চাহি-

তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি

জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি

বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।

দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-

উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!

হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন

শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন

সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি

একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।

প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি

চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!

মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,

সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।

কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই

পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই

উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,

তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'


...ভৃত্য দস্ত চুমি

কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?

উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি

আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?'

খলিফা হাসিয়া বলে,

'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।

রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে

করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'

কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।

আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।

আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।

ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।


ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,

মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।

জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,

কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা।

জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-

অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয় হে মানব।'

* * * * * * * * * *

তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,

সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।

মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,

তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,

সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,

বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।


মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,

মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী

নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে

মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে


কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,

উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।

শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে

বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,

বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে,

আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'।

কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,

বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!

রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?

মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার

প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে

পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!

এত যে কোমল প্রাণ,

করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান!

মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে

মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে!

ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-

'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'


আবু শাহমার গোরে

কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।


খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,

'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,

একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,

রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।

হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!

অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,

মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই

তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।

No comments