ইন্দ্র-পতন -কাজী নজরুল ইসলাম।
তখনো অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু
অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরু-গুরু-গুরু!
আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী?
শুনি, অন্দুব-কম্বু- নিনাদে ঘন বৃঙ্ঘিত- ধ্বনি।
বাজে চিক্কুর- হ্রেষা- হর্ষণ মেঘ- মন্দুরা- মাঝে,
সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ংকর সাজে।
ঘনায় অশ্রু-বাষ্প- কুহেলি ঈশান- দিগঙ্গনে,
স্তব্ধ- বেদনা দিগ-বালিকারা কী যে কাঁদুনী শোনে!
কাঁদিছে ধরার তরু-লতা-পাতা, কাঁদিছে পশু-পাখী,
ধরার ইন্দ্র স্বর্গে চলেছে ধূলির মহিমা মাখি'।
বাজে আনন্দ- মৃদং গগনে, তড়িৎ-কুমারী নাচে,
মর্ত্য- ইন্দ্র বসিবে গো আজ স্বর্গ- ইন্দ্র কাছে।
সপ্ত- আকাশ- সপ্তস্বরা হানে ঘন করতালি,
কাঁদিছে ধরায় তাহারি প্রতিধ্বনি-খালি, সব খালি!
হায় অসহায় সর্বংসহা মৌনা ধরণী মাতা,
শুধু দেব- পূজা তরে কি মা তর পুষ্প হরিৎমাতা?
তোর বুকে কি মা চির-অতৃপ্ত রবে সন্তান-ক্ষুধা?
তোমার মাটির পাত্রে কি গো মা ধরে না অমৃত-সুধা?
জীবন- সিন্ধু মথিয়া যে-কেহ আনিবে অমৃত-বারি
অমৃত-অধিপ দেবতার রোষ পড়িবে কি শিরে খাঁটি
তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন, যারে ভালোবাসে মাটি।
কাঁটার মৃণালে উঠেছিল ফুটে যে চিত্ত- শতদিল
শোভেছিল যাহে বাণী কমলার রক্ত-চরণ-তল,
সম্ভ্রম-নত পূজারী মৃত্যু ছিঁড়িল সে শতদলে-
শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য অর্পিবে বলি' নারায়ণ-পদতলে!
জানি জানি মোরা, শংখ-চক্র-গদা যাঁর হাতে শোভে-
পায়ের পদন হাতে উঠে তাঁর অমর হইয়া র'বে।
কত শান্ত্বনা- আশা-মরিচিকা কত বিশ্বাস-দিশা
শোক- সাহারায় দেখা দেয় আসি, মেটে না প্রানের তৃষা!
দুলিছে বাসুকি মণীহারা ফণী, দুলে সাথে বসুমতী,
তাহার ফনার দিন-মণি আজ কোন গ্রহে দেবে জ্যোতি!
জাগিয়া প্রভাতে হেরিনু আজিকে জগতে সুপ্রভাত,
শয়তানও আজ দেবতার নামে করিছে নান্দীপাঠ!
হে মহাপুরুষ, মহাবিদ্রোহী, হে ঋষি, সোহম-স্বামী!
তব ইঙ্গিতে দেখেছি সহসা সৃষ্টি গিয়াছে থামি',
থমকি গিয়াছে গতির বিশ্ব চন্দ্র- সূর্য- তারা,
নিয়ম ভুলেছে কঠোর নিয়তি, দৈব দিয়াছে সাড়া!
যখনি স্রষ্ঠা করিয়াছে ভুল, ক'রেছ সংস্কার,
তোমারি অগ্রে স্রষ্টা তোমারে ক'রেছে নমস্কার!
ভৃগুর মতন যখনি দেখেছ অচেতন নারায়ণ,
পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, জেগেছে জগজ্জন!
ভারত-ভাগ্য-বিধাতা বক্ষে তব পদ-চিন ধরি'
হাঁকিছেন, 'আমি এমন করিয়া সত্য স্বীকার করি!
জাগাতে সত্য এত ব্যাকুলতা এত অধিকার যার,
তাহার চেতন- সত্যে আমার নিযুত নমস্কার!'
আজ শুধু জাগে তব অপরূপ সৃষ্টি- কাহিনী মনে,
তুমি দেখা দিলে অমিয়-কন্ঠ বাণীর কমল-বনে!
কখন তোমার বীণা ছেয়ে গেল সোনার পদন-দলে,
হেরিনু সহসা ত্যাগের তপন তোমার ললাট-তলে!
লক্ষী দানিল সোনার পাপড়ি, বীণা দিল করে বাণী,
শিব মাখালেন ত্যাগের বুভূতি কন্ঠে গরল দানি',
বিষ্ণু দিলেন ভাঙ্গনের গদা, যশোদা-দুলাল বাঁশি,
দিলেন অমিত তেজ ভাস্কর, মৃগাঙ্ক দিল হাসি।
চির গৈরিক দিয়া আশিসিল ভারত-জননী কাঁদি',
প্রতাপ শিবাজী দানিল মন্ত্র, দিল উষ্ণীষ বাঁধি'।
বুদ্ধ দিলেন ভিক্ষাভান্ড, নিমাই দিলেন ঝুলি,
দেবতারা দিলেন মন্দার-মালা, মানব মাখালো ধূলি।
নিখিল-চিত্ত-রঞ্জন তুমি উদিলে নিখিল ছানি'-
মহাবীর, কবি, বিদ্রোহী, ত্যাগী, প্রেমিক, কর্মী, জ্ঞানী!
হিমালয় হ'তে বিপুল বিরাট উদার আকাশ হ'তে,
বাধা-কুঞ্জর তৃণ-সম ভেসে গেল তব প্রান-স্রোতে!
ছন্দ গানের অতীত হে ঋষি, জীবনে পারিনি তাই
বন্দিতে তোমা',আজ আনিয়াছি চিত্ত-চিতার ছাই!
বিভূতি-তিলক! কৈলাস হ'তে ফিরেছ গরল পি'ইয়া,
এনেছি অর্ঘ্য শ্মশানের কবি ভস্ম বিভূতি নিয়া!
নাও অঞ্জলি, অঞ্জলি নাও, আজ আনিয়াছি গীতি
সারা জীবনের না-কওয়া কথার ক্রন্দন-নীরে তিতি'!
এত ভালো মোরে বেসেছিলে তুমি, দাওনি ক' অবসর
তোমারেও ভালোবাসিবার, আজ তাই কাঁদে অন্তর!
আজিকে নিখিল-বেদনার কাছে মোর ব্যথা যতটুক,
ভাবিয়া ভাবিয়া স্বান্ত্বনা খুঁজি, তবু হা হা করে বুক~
আজ ভারতের ইন্দ্র-পতন,বিশ্বের দুর্দিন,
পাষান বাংলা প'ড়ে এককোনে স্তব্ধ অশ্রুহীন!
তারি মাঝি হিয়া থাকিয়া গুমরি' গুমরি' ওঠে,
বক্ষের বাণী চক্ষের জলে ধুয়ে যায়, নাহি ফোটে!
দীনের বন্ধু, দেশের বন্ধু, মানব-বন্ধু তুমি,
চেয়ে দেখ আজ লুটায় বিশ্ব তোমার চরণ চুমি'।
গগনে তেমনি ঘনায়েছে মেঘ, তেমনি ঝরিছে বারি,
বাদলে ভিজিয়া শত স্মৃতি তব হ'ইয়ে আসে ঘন ভারি
পয়গম্বর ও অবতার- যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,
দেখিনি ক' মোরা তাঁদের, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ,
কিন্তু যখনি বসিতে পেয়েছি তোমার চরণ-তলে
না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভ'রেছে জলে!
সারা প্রান যেন অঞ্জলি হ'য়ে ও-পায়ে প'ড়েছে লুটি',
সকল গর্ব উঠেছে মধুর প্রণাম হইয়া ফুটি'!
বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনি ক' চোখে তাহে,
নাহি আফসোস, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহানশাহে;
নিমাই লইল সন্ন্যাস প্রেমে, দিইনি ক' তারে ভেট,
দেখিয়াছি মোরা 'রাজা-সন্ন্যাসী', প্রেমের জগৎ- শেঠ!
শুনি, পরার্থে প্রান দিয়া দিল অস্থি বনের ঋষি;
হিমালয় জানে, দেখেছি দধীচি গৃহে ব'সে দিবানিশি!
হে নবযুগের হরিশ্চন্দ্র! সাড়া দাও, সাড়া দাও!
কাঁদিছে শ্মশানে সুত-কোলে সতী, রাজর্ষি ফিরে চাও!
রাজকুলমান পুত্র-পত্নী সকল বসর্জিয়া
চন্ডাল-বেশে ভারত-শ্মশান ছিলে একা আগুলিয়া,
এস সন্ন্যাসী, এস সম্রাট, আজি সে শ্মশান-মাঝে,
ঐ শোনো তব পুন্য জীবন- শিশুর কাঁদন বাজে!
দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যূপে ফেলে
ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ বীর বারে বারে অবহেলে।
ইবরাহিমের মত বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
কোরবানী দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া।
ফেরেশতা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,
ভগবান-বুক মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!
প্রজা-রঞ্জন রাম-রাজা দিল সীতারে বিসর্জন,
তাঁরও হয়েছিল যজ্ঞে স্বর্ণ-জানকীর প্রয়োজন,
তব ভান্ডার- লক্ষীরে রাজা নিজ হাতে দিলে তুলি'
ক্ষুধা-তৃষাতুর মানবের মুখে, নিজে দিলে পথ-ধূলি,
হেম-লক্ষীর তোমারও জীবন-যাগে ছিল প্রয়োজন,
পুড়িলে যজ্ঞে, তবু নিলে না ক' দিলে যা বিসর্জন!
তপোবলে তুমি অর্জিলে তেজ বিশ্বামিত্র-সম,
সারা বিশ্বের ব্রাম্মন তাই বন্দিছে নমো নমো!
হে যুগ- ভীষ্ম! নিন্দার শরশয্যায় তুমি শুয়ে
বিশ্বের তরে অমৃত-মন্ত্র বীর-বাণী গেলে থুয়ে!
তোমার জীবনে বলে গেলে- ওগো কল্কি আসার আগে
অকল্যানের কুরুক্ষেত্রে আজো মাঝে মাঝে জাগে
চির-সত্যের পাঞ্চজন্য, কৃষ্ণের মহাগীতা,
যুগে যুগে কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা!
তুমি নব ব্যাস, গেলে নবযুগ-জীবন-ভারত চরি'
তুমিই দেখালে-ইন্দ্রেরই তরে পারিজাত-মালা শচী!
আসিলে সহসা- অত্যাচারীর প্রাসাদ-স্তম্ভ টুটি'
নব-নৃসিংহ-অবতার তুমি, পড়িল বক্ষে লুটি'
আর্ত-মানব-হৃদি-প্রহ্লাদ, পাগল মুক্তি-প্রেমে!
তুমি এসেছিলে জীবন গঙ্গা তৃষাতুর তরে নেমে!
দেবতারা তাই স্তম্ভিত হের' দাঁড়ায়ে গগন তলে
নিমাই তোমারে ধরিয়াছে বুকে, বুদ্ধ নিয়াছে কোলে!
তোমারে দেখিয়া কাহারো হৃদয়ে জাগেনি ক' সন্দেহ
হিন্দু কিম্বা মুসলিম তুমি অথবা অন্য কেহ।
তুমি আর্তের, তুমি বেদনার, ছিলে সকলের তুমি,
সবারে যেমন আল দেয় রবি, ফুল দেয় সবে ভূমি!
হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি মুসলিমের আরংজিব,
যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব!
নিন্দা-গ্লানির পঙ্ক মাখিয়া, পাগল, মিলন-হেতু
হিন্দু- মুসলমানের পরানে তুমিই বাঁধিলে-সেতু!
জানিনা আজি কে অর্ঘ্য দেবে হিন্দু-মুসলমান,
ঈর্ষা-পঙ্কে পঙ্কজ হ'য়ে ফুটুক এদের প্রান!
হে অরিন্দম, মৃত্যুর তীরে ক'রেছ শত্রু জয়,
প্রেমিক! তোমার মৃত্যু-শ্মশান আজিকে মিত্রময়!
তাই দেখি, যারা জীবনে তোমায় দিল কন্টক-হুল,
আজ তাহারাই এনেছে অর্ঘ্য নয়ন-পাতার ফুল!
কি যে ছিলে তুমি জানি না ক' কেহ, দেবতা কি আওলিয়া,
শুধু এই জানি, হেরি আর কারে ভরেনি এমন হিয়া।
আজি দিকে দিকে বিপ্লব-অহিদল খুঁজে ফেরে ডেরা,
তুমি ছিলে এই নাগ-শিশুদের ফণী-মনসার বেড়া!
তুমিই রাজার ঐরাবতের পদতল হ'তে তুলে
বিষ্ণু-শ্রীকর-অরবিন্দরে আবার শ্রীকরে থুলে!
তুমি দেখিছিলে ফাঁসির গোপীতে বাঁশির গোপীমোহন,
রক্ত-যমুনা-কূলে রচে' গেলে প্রেমের বৃন্দাবন!
তোমার ভগ্ন চাকায় জরায়ে চালায়েছে এরা রথ,
আপন মাথার মানিক জ্বালায়ে দেখায়েছে রাতে পথ,
আজ পথহারা আশ্রয়হীন সাপুড়ে মারণ- মন্ত্র সুরে!
যেদিকে তাকাই কূল নাহি পাই, অকূল হতাশ্বাস,
কোন শাপে ধরা স্বরাজ-রথের চক্র করিল গ্রাস?
যধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী,
ঐ হের' দূরে কৌরব-সেনা উল্লাসে ওঠে নাচি'।
হিমালয় চিরে আগ্নেয়-বাণ চীৎকার করি' ছুটে,
শত ক্রন্দন-গঙ্গা যেন গো পড়িছে পিছনে টুটে!
স্তব্ধ- বেদনা গিরিরাজ ভয়ে জলদে লুকায় কায়-
নিখিল অশ্রু সাগর বুঝি বা তাহারে ডুবাতে চায়!
টুটিয়াছে আজ গর্ব তাহার, লাজে নত উঁচু শির,
ছাপি' হিমাদ্রি উঠিছে প্রণাম সমগ্র পৃথিবীর!
ধূর্জটি-জটা-বাহিনী গঙ্গা কা৬দিয়া কাঁদিয়া চলে,
তারি নিচে চিতা- যেন গো শিবের ললাটে অগ্নি জ্বলে!
মৃত্যু আজিকে হইল অমর পরশি' তোমার প্রান,
কালো মুখ তার হ'ল আলোময়, শ্মশানে উঠিছে গান।
অগুরু- পুষ্প-চন্দন পুড়ে হল সুগন্ধতর,
হ'ল শুচিতর অগ্নি আজিকে, শব হ'ল সুন্দর!
ধন্য হইল ভাগীরথী-ধারা তব চিতা-ছাই মাখি',
সমিধ হইল পবিত্র আজি কোলে তব দেহ রাখি'!
অসুর নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে
আঁখি উপাড়িতে গেছিলেম রাম, আজিকে পড়িছে মনে;
রাজর্ষি! আজি জীবন উপাড়ি দিলে অঞ্জলি তুমি,
দনুজ- দলনী জাগে কিনা-আছে চাহিয়া ভারত-ভূমি!
No comments