Breaking News

ভালোবাসা এরকম ও হয়

 ভালোবাসা এরকম ও হয়




আমার বিয়ের ৯ বছর চলছে। শ্বশুর+জামাই খুব প্রভাবশালী। আমার জামাই একমাত্র ছেলে সন্তান। পরিবারের বড় সন্তান। বাকি সব ননদ। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। নিঃসন্তান আমি। এতবড় বাড়িতে আমরা এই চারজন থাকি। আমার স্বামী খুব ভাল মানুষ। কোনো রকম বদ অভ্যাস বা নারী ঘটিত সম্পর্ক নাই। কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, ছুটিতে ঘুরতে যাই বা বাসায় বসে খাওয়াদাওয়া গল্প করে কাটাই।
সবকিছুর ভিতর খুব কষ্ট লাগে। একা লাগে খুব। সমস্যা আমার ভিতর তাই মা হতে পারি না। এক ওয়াজে শুনেছি যেসব পুরুষরা বাবা হতে অক্ষম তাদের নাকি বিয়ে করা জায়েজ নাই। অন্য একজনের লাইফ নষ্ট করার অধিকার নাই। আমিও তো মা হতে পারব না, তাহলে আমারও তো রাইট নাই কারও জীবন নষ্ট করার।
হয়ত বলবেন সন্তান সবকিছু না। আমিও জানি সন্তান সবকিছু না, সবকিছু না হলেও অনেক কিছু। অনেক কিছু।
যাক, আমি কখনো মুখ ফুটে না বললেও মনে মনে ঠিক করেছি উনি আরেকটা বিয়ে করতে চাইলে আমার কষ্টটা আমি ধামাচাপা দিয়ে রাখব। আমি মা হতে না পারি, উনি তো বাবা হতে পারবেন। আমার জন্য উনি কেনো ওয়ারিশহীন থাকবেন?
এই ৯ বছরে একবারও এমন কথা উঠে নাই। বা উনি কখনো আমার কাছে সন্তানের জন্য হাহাকার প্রকাশ করেন নাই। আজ থেকে ৬ মাস আগে পারিবারিক এক দাওয়াতে উনি উনার কাজিনকে কথা প্রসংগে জানান যে উনার খুব ইচ্ছে উনার নিজের সন্তান থাকবে। বাবা হবে ইত্যাদি। তো কাজিন তাকে ২য় বিয়ের পরামর্শ দেন। পরে কাজিনের বউ আমাকে জানান, হাসতে হাসতেই বলেন যে শুনলাম ভাইয়া নাকি আরেকটা বিয়ে করবে? আমার স্বামী আরেক বিয়ে করবে তা আমি জানি না, অন্যের কাছ থেকে শুনতে হয়! কষ্টে কান্না আসলেও আমি হেসে দিয়ে বলি, তা খুঁজে দেন একটা বউ।
আমাকে নরমাল দেখে ভাবি এবার নরম করে বললেন, আসলে সবাই কানাঘুষা করে তোমাদেরকে নিয়ে। সেদিন ভাইয়া খুব মায়া করে বলছিলেন উনার যদি একটা সন্তান থাকত।
সেদিন রাতে আমার আর ঘুম হয় নাই। উনি আমাকে সব সময় সাপোর্ট দিয়ে বলেছেন বাচ্চা না হলে না হবে, এতে মন খারাপ করবে না। অথচ উনি ভিতরে ভিতরে এত আকুতি নিয়ে থাকেন।
আমার ভীষণ কান্না পেলো, মনে হচ্ছিল খুব সহসা উনি আরেক বিয়ে করবেন। এসব ভাবতেই আমি অসাড় হয়ে আসছিলাম। যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার এই ৯ বছরের সংসারটা আমাকে পর করে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে করে আমার সব কিছু অন্যের হয়ে যাচ্ছে। আমি নাই হয়ে যাচ্ছি।
আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশ করিনাই একটুও। খুব স্বাভাবিক ছিলাম। মাস খানেকের ভিতর মোটামুটি রিলেটিভস সবাই একমত যে উনার ২য় বিয়ে করা উচিৎ। আমিও তালে তাল মিলাচ্ছি। বুঝাচ্ছি আমার কোনো অমত না নারাজি নাই। কিন্তু দিন শেষে একা হলেই আমি চিৎকার করে কান্না করতাম। কারও কোনো দোষ নাই, কেউ আমার উপর জুলুন করছে না। সামান্য কটু কথা বলছে না। কাকে কি বলব আমি? বিচার দেওয়ার মত কোনো অপরাধও কেউ করছে না। তবুও এত কষ্ট হচ্ছে আমার।
মেয়ে পছন্দ হয়েছে। মেয়ের পরিবার একেবারেই সাদামাটা। মেয়ে আমার স্বামী থেকে ১৮ বছরের ছোটো। অবশ্য মেয়ে দেখা পছন্দ করা এসবে আমি ছিলাম না। কিন্তু এত কম বয়সী মেয়ে কারও ২য় স্ত্রী হতে রাজি হয়েছে শুনে পিলে চমকে গেলাম। সত্য বলতে কী, আমি উনার ২য় বিয়েতে অমত নই, কিন্তু এই মেয়ে আমার পছন্দ হয় নাই। মেয়ের লেখাপড়া নাই, সাংসারিক কোনো গুন নাই, পরিবারও শিক্ষিত না। এক কথায় কুফু মিলে না। ওদের চাল চলন কথাবার্তা কোনো কিছুর সাথেই যায় না। কেন সবাই রাজি হল বুঝছিনা। হয়ত ভাবছে কম বয়সী কুমারী মেয়ে। ২য় বউ হতে রাজি হয়েছে এই বেশ! আমি কিছুই বলিনি, পরে না আবার ভাবে বিয়ে ভেংগে দেওয়ার চাল।
আকদের দিন তারিখ ঠিক হল। পরে তুলে আনা হবে। বিয়ের শপিং করলাম আমি সহ। যত দিন ঘনিয়ে আসে তত আমি কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছে আমার সংসার ভাংগার দিন ঘনিয়ে আসছে। এক রাতে এসব ভেবে ভেবে অনেক কান্না করে দিলাম। জামাইর ঘুম ভেংগে গেল। পরে খুব চাপাচাপি করলে আমি বলি আমার মনের হালত। আমার সংগে উনিও কান্না করলেন। ওয়াদা দিলেন কোনো দিন আমাকে কষ্ট দিবেন না। আমার স্থান, মর্যাদা, আমার প্রতি ভালবাসা কোনো দিন নড়বড় হবে না। আমি যেমন ছিলাম তেমন থাকব। আমার পাশে আমাকে নিয়ে উনি যেমন ছিলেন সব সময় তেমন থাকবেন।
এসব আশ্বাস শুনে আমার কান্না থামল। দিলে শান্তি আসল। কিন্তু যেই না শুইতে গেলাম ওমনে আবার কান্না আসল। আমি ভাল করেই জানি ওই মেয়ে মা হওয়ার পর থেকেই সব বদলাতে থাকবে।
বিয়ের আগের দিন মেয়ের বাবা জানালো আকদের দিন আমি তাদের ঘরে যেতে পারব না। তাদের আত্মীয়রা নাকি জানে না আমার কথা। জানলে বিয়ে ভেংগে দিবে নাকি। উনি আমাকে খুব আদর ভালবাসা দিয়ে মাফ চেয়ে কথাটা জানালেন। অনেক কষ্ট পেলাম আমি। এভাবেই একে একে সব কিছু থেকে আমাকে সরিয়ে ফেলা হবে। অমুক জানলে সমস্যা, তমুক কষ্ট পাবে এসব বলে বলে আমাকেই পর করে দেয়া হবে।
আকদের দিন সকালে উনাকে আমি রেডি করে দিলাম। প্রতি জুমআয় যেভাবে দেই সেভাবে। আতর মেখে দিতে দিতে বললাম, প্রতি জুমআয় এভাবে তৈরি করে দিতে চাই। সম্ভব?
উনি আমার দিকে হাসি মুখ করে বললেন সম্ভব।
আমি জানি, এখন সব এমনেই বলছে। এক্সাইটেড হয়ে আছে বিয়ে নিয়ে। এখন যদি বলি তোমার বাড়িটা আমার নামে লিখে দেও তাতেও রাজি হয়ে যাবে।
যাক। সবাই গেলো। নামাজের পর আকদ হবে। আমি এক রাশ মন খারাপ নিয়ে জায়নামাজে বসে আছি। কেন যেন আর কান্না আসছে না। অভিমান চাপে, আবার নিজেকেই বকি। অভিমান কেন চাপবে, সমস্যা তো আমার মাঝেই। আমার তো উচিৎ নিজের সমস্যা নিয়ে তার জীবন থেকেই সরে যাওয়া। ২ জন খালা আছে, সংসারের কোনো কাজই আমার করা লাগে না। পুরাটাদিন আমার শুয়ে বসে কাটে। কোনো ব্যস্ততা নাই। কিছুই নাই। এমন এক বোঝাকে তারা আদরযত্ন করে খাওয়াচ্ছে পালছে। আর কত। নিজেকে পুরাই আগাছা আগাছা লাগছিল।
আমাকে কল দিয়ে জানালো, বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে। আমি বারান্দায় বসে শূন্যে তাকিয়ে ছিলাম। সন্ধ্যায় মেসেজ পাঠালো, এখন তাকে বাসর ঘরে নিয়ে যাবে।
আমি ওজু করে নামাজ আদায় করে এই গ্রুপে এসে সবার লেখা পড়তে শুরু করলাম। কী কষ্ট একেকজনের জীবনে। সেই তুলনায় আমারটা তো কিছুই না। এসব ভেবে নিজের কষ্ট কমাচ্ছিলাম। বার বার মেসেজ চেক করি এই বুঝি উনি বলবেন আমাকে মিস করছেন। কিন্তু আর কোনো মেসেজ আসে না।
একটু পর বাসার সবাই চলে আসল। বিয়ে নিয়ে সবাই আলোচনা সমালোচনা করছে। যা বুঝলাম মেয়ে পক্ষের আদর আপ্যায়ন তাদের পছন্দ হয় নাই। না হবারই কথা। মেয়েরা নিম্নবিত্ত, আর এই ঘরের মানুষের মাসিক হাত খরচই মেয়েদের পুরা বছরের খরচের সমান। যাক আল্লাহ এখানেই ভাল মনে করেছেন। আমার উনি বাবা হবেন এটাই আনন্দ আমার। মাঝে মাঝে আমি একটু আদর করব বাবুকে এটাই পাওয়া।
শাশুড়ি জানালেন ২ দিন পর মেয়ের বাসার সবাই আসবে। আমি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলাম আমি তাহলে মায়ের ওখানে যাব। শাশুড়ি আমতা আমতা করে বলেন, না তোমার যেতে হবে না। আমি বলব তুমি আমার ভাইর মেয়ে।
রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। লাস্ট কবে একা ঘুমাইছি আমার মনে নাই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। উনি এখন অন্য মেয়ের সাথে, প্রেম ভালবাসা করছে। হাত ধরছে, হাসছে, কথা বলছে, আমাকে একদম ভুলে গেছে এসব ভেবে হুহু করে কান্না করছিলাম। নিজের ঘরে নিজের ৯ বছরের সংসারে এখন আমাকে ভাইয়ের মেয়ে পরিচয়ে থাকতে হবে। ঠিক এভাবেই আমি পর হয়ে যাব।
কখন যেন ঘুমালাম। ঘুমের ঘোরেও বার বার মোবাইক চেক করি এই বুঝি উনি বলবেন তোমাকে ছাড়া ভাল লাগছে না।
এক সময় সত্যিই উনার মেসেজ আসল। “আমার ভাল লাগছে না আমার দম বন্ধ লাগছে প্লিজ তুমি আসো। আমাকে নিয়ে যাও”
আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম। কি হল বলে বলে মেসেজ দিচ্ছি উত্তর নাই। কল দিচ্ছি উত্তর নাই। আমার হার্টবিট এত ফাস্ট হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারাবো। একবার ভাবি মাকে জাগাই। আবার ভাবি এড্রেস নিয়ে এখুনি ওদের বাসায় চলে যাই। এসব ভাবতে ভাবতে ঘন্টাখানেক কেটে গেল। উনার মেসেজ আসল আবার- দরজা খুলো, কাউকে জাগাইও না।
আমি দরজা খুলে দেখি উনি দাঁড়িয়ে। আশেপাশে খুঁজে দেখি আর কেউ আছে কিনা। উনি আমার হাত ধরে সোজা বেডরুমে এসে বিছানায় বসেই গড়গড় করে সব বলা শুরু করলেন।
“ বাসর ঘরে আমি মেয়েকে তোমার কথা বলছিলাম যেন তোমাকে রিস্পেক্ট করে। বড় বোনের মত ভাবে। এই কথা শুনেই মেয়ে রেগে গেলো, বলে মানে কি! আমি তো জানি আপনি উনাকে ছেড়ে দিবেন। আপনাদের সম্পর্ক ভাল না।
আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি। আমি বললাম এমন তো কোনো কথা ছিল না। কথা ছিল আমি দুই বউ নিয়েই থাকব। পরে মেয়ে উঠে তার বাবাকে ডেকে আনে। বলে বাবা নাকি বলছে এই কথা। আমি মেয়ের বাবাকে জিগেস করলে উনি খুব রিয়েক্ট করে বলেন তোমার স্ত্রীর বাচ্চা হয় না, তোমার বয়স কত বেশি আমার মেয়ে থেকে। এত কম বয়সী মেয়ে বিয়ে দিছি এরে নিয়ে থাকবা। ঐ মহিলাকে রাখবা কিসের জন্য? আজকাল কে এমন বিয়ে দেয়? ওই বউরে ছেড়ে দিবা নাহয় আমার মেয়ে দিব না।
সে একথা বলা মাত্র আমি বললাম দিয়েন না আপনার মেয়ে। তাও আমি আমার স্ত্রীকে ছাড়ব না। সে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। তারপর কিছুক্ষণ এসব নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় এরপর আমি চলে আসছি”
“জানো আমাকে যখন বলছিল তোমাকে ছাড়তে হবে আমার মনে হচ্ছিল আমার পায়ের নিচের জমিন সরে গেছে। আমি এই ৯ বছরেও বুঝিনাই তুমি আমার জন্য কী, এই কথা শুনা মাত্র আমার যে অনুভূতি হয়েছে তাতে মনে হচ্ছিল আমার বাবা হওয়া লাগবে না। আমার তুমি থাকলেই হবে”
অনেকের মনে হতে পারে কোনো গল্প বলছি, কিন্তু গল্প না। পরবর্তীতে পারিবারিক বৈঠকে ওদের তালাক হয়ে যায়। মেয়ের বাবা শর্ত দেয় আমাকে ছেড়ে দিলে উনি মেয়ে দিবে। আমার জামাই উনার মেয়েকেই ছেড়ে দেয়।
আমি হয়ত মা হতে পারিনি। কিন্তু একজন সার্থক স্ত্রী হতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমার জন্য দুয়া করবেন। আমার ইনফারটিলিটি, সিস্ট, থাইরয়েড আছে। এসবের মাঝেও যেন আল্লাহ মা হওয়ার তাউফিক দেন।

No comments